সিনেমার গল্প: কিল দা মেসেঞ্জার

সিনেমায় নানা জনর আছে। আমার অন্যতম পছন্দের জনর হচ্ছে রাজনীতি, সংঘাত, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ইত্যাদি। আর যদি তা সত্য কোনো কিছু নিয়ে হয় তাহলে তো কথাই নেই। ভাবছি আমার দেখা এ ধরনের সিনেমা নিয়ে লিখব। নিয়মিত বা ধারাবাহিক হবে কি না তা নির্ভর করছে সময়ের ওপরে। এটা প্রথম পর্ব।

গ্যারি স্টিফেন ওয়েব একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক। পুলিৎজারও পেয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে যোগ দেন ক্যালিফোর্নিয়ার সান হোসে মার্কারি নিউজ নামের একটি পত্রিকায়। নিজে থেকে বিষয় খুঁজে খুঁজে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতেন গ্যারি ওয়েব। এই এলাকায় মাদকের বিস্তার ছিল ব্যাপক। বিশেষ করে আফ্রিকান-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর মধ্যে। মাদক বা ড্রাগের পেছনে লাগলেন গ্যারি ওয়েব। খুঁজতে গিয়ে বলা যায় খনি আবিষ্কার করলেন তিনি।

index

অস্কার ডানিলো ব্লানডন একজন নিকারাগুয়ান, লস অ্যাঞ্জেলস এলাকার সবচেয়ে বড় মাদক সরবরাহকারীদের একজন। দেশটির সামোজো সরকারের সময় একজন বড় কর্মকর্তা ছিলেন। সামোজা সরকারের পতনের পরে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে আসেন। তারপর জড়িয়ে পড়েন মাদক ব্যবসায়। ডানিলো ব্লানডন ধরা পরলে বিচার শুরু হয়। ব্লানডনের বান্ধবীই ছিল গ্যারি ওয়েবের প্রথম সোর্স। ধীরে ধীরে জানতে পারেন অনেক গোপন তথ্য।

ডানিলো ব্লানডনের মাদক ব্যবসার বড় পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে সিআইএ। আর ক্রেতা হচ্ছে মূলত আফ্রিকান-আমেরিকানরা। মাদক ব্যবসার লাভের অর্থ চলে যায় কন্ট্রা গেরিলাদের কাছে। মূলত এটাই ছিল কন্ট্রাদের সাহায্য করার সিআইএ পদ্ধতি।

এবার একটু নিকারাগুয়ার ইতিহাসের দিকে চোখ দিতে পারি। মার্কিন সামরিক বাহিনী ১৯৩৩ সালে নিকারাগুয়া ছেড়ে যাওয়ার সময় আনাস্টিও সামোজার অধীনে ন্যাশনাল গার্ড নামের একটি বাহিনী রেখে যায়। এর তিন বছরের মাথায় সামোজা দেশটির প্রেসিডেন্ট হন। পরের ৪৩ বছর ছিল সামোজা পরিবারের। ১৯৭৯ সালের জুলাইয়ে স্যান্ডানিস্টাদের হাতে উৎখাত হয়ে দ্বিতীয় আনাস্টিও সামোজা যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। স্যান্ডানিস্টারা ছিল ছিল বামপন্থী। খুব স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নতুন সরকারকে পছন্দ করেনি। অপছন্দ তীব্র হয় রোনাল্ড রিগ্যান যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হলে। নিকারাগুয়াকে সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা থেকে বের করতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দেশটির কন্ট্রা বিদ্রোহীদের সব ধরনের সহযোগিতা করা। কন্ট্রা গেরিলারা স্যান্ডানিস্টাদের বিরুদ্ধে গেরিলা কার্যক্রম শুরু করে। আর এ জন্য সব ধরনের সহায়তা দেয় সিআইএ। নানা ভাবে সহায়তা দেওয়া হতো। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাদক ব্যবসায় সহযোগিতা করা। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে এই মাদক বিক্রি হতো এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও। গ্যারি ওয়েব এই চক্রটিই খুঁজে বের করেন।

১৯৯৫ সালের জুলাই মাস থেকে অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন গ্যারি ওয়েব। আর সান হোসে মার্কারি নিউজ পেপারে প্রথম রিপোর্ট ছাপা হয় ১৯৯৬ সালের ১৮ আগস্ট। তিন ধরে সিরিজ রিপোর্টটি ছাপা হয়। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ডার্ক অ্যালায়েন্স’। ছাপা হতেই যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। গ্যারি ওয়েব রাতারাতি সবচেয়ে বিখ্যাত সাংবাদিকে পরিণত হন।

dark_alliance_540

সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া আসে দেশটির আফ্রিকান-আমেরিকান অধিবাসীদের মধ্য থেকে। এর আগে সিআইএ নানা ভাবে চেষ্টা করেছিল গ্যারি ওয়েব যাত রিপোর্ট না লেখেন। কিন্তু কাজ হয়নি। সিআইএ ব্যর্থ হয়ে অন্য পথ নেয়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। দেওয়া হয় নানা হুমকি। সবচেয়ে কলঙ্কজনক কাজটি করেছিল দেশটির প্রধান প্রধান মিডিয়াগুলো। ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ নিউ ইয়র্ক টাইমস ও লস অ্যাঞ্জেলস টাইম পাল্টা রিপোর্ট করে গ্যারি ওয়েবকে নিয়ে। বিষয় ছিল রিপোর্টে কী কী ভুল আছে তা বের করা। বলা হয় গ্যারি ওয়েবের সূত্র মূলত মাদক ব্যবসায়ীরা, যা পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য না। প্রবল চাপ আসে সান হোসে মার্কারি নিউজের ওপরেও। ১৯৯৭ সালে তারা গ্যারি ওয়েবের পেছন থেকে সরে আসে। পত্রিকার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, গ্যারি ওয়েবের রিপোর্ট পুরোপুরি সঠিক ছিল না, সম্পাদনায় ঘাটতি ছিল। এরপর গ্যারি ওয়েব পদত্যাগ করেন। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন সরকারি সংস্থাও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে। এবং সেখানেও বলা হয় গ্যারি ওয়েবের তথ্য পুরোপুরি সঠিক ছিল না।

রাতারাতি বিখ্যাত হয়েছিলেন গ্যারি ওয়েব, আবার রাতারাতি কলঙ্কের ভাগীদার হন। নিজ কমিউনিটি থেকেও কোনো সহায়তা পাননি তিনি। বরং ঈর্ষার শিকার হন। সিআইএর বিরুদ্ধে আরও অনুসন্ধানী রিপোর্ট না করে তারা বরং সিআইএর পক্ষ নেয়। এর ফল হয় মারাত্মক। গ্যারির সংসার টেকেনি। জীবনে আর কখনো কোথাও সাংবাদিকতার চাকরি পাননি। আর্থিক কষ্ট ছিল প্রবল। ২০০৪ সালে আত্মহত্যা করেন গ্যারি ওয়েব। তার শরীরে দুটি গুলির চিহ্ন ছিল। আত্মহত্যা করতে কি দুইবার নিজ শরীরে গুলি করা সম্ভব? এই প্রশ্নও উঠেছিল। সন্দেহ ছিল খুনের। তবে এখন পর্যন্ত এটিকে আত্মহত্যাই বলা হচ্ছে।

আরও অনেক পরে সিআইএ বেশ কিছু গোপন নথি প্রকাশ করে। এর একটি নথি ছিল কন্ট্রাদের সহায়তা করা নিয়ে। সেখানে স্বীকার করা হয় যে কন্ট্রাদের সাহায্য করতে সিআইএ মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করেছিল। আরও পরে সিআইএ প্রকাশ করে আরকটি নথি। সেটি ছিল গ্যারি ওয়েবকে নিয়ে। গ্যার ওয়েবকে ঠেকাতে কী কী করেছিল তার বিবরণ। কিন্তু তা দেখার অবস্থায় ছিলেন না গ্যারি ওয়েব।

455652

এবার সিনেমা প্রসঙ্গ। ২০১০ সালের সিনেমা ‘কিল দা মেসেঞ্জার’। পুরো সিনেমাটা গ্যারি ওয়েবকে নিয়ে। বেঁচে থাকতেই গ্যারি ওয়েব তাঁর অনুসন্ধানের পদ্ধতি নিয়ে লিখে গিয়েছিলেন। সেটা নিয়েই সিনেমা। জেরেমি রেনার গ্যারি ওয়েবের ভূমিকায়। একবার শুরু করলে শেষ না করো উঠতে পারবেন না।

v1.bTsxMTE4OTU5MTtqOzE3NDk5OzEyMDA7ODAwOzEyMDA

কিল দা মেসেঞ্জার নামটাই অনেক কিছু বলে দেয়। কি বার্তা আনল সেটি বড় বিষয় নয়। কে আনল, কেন আনল সেটাই মূল। সুতরাং বার্তাবাহককে সরিয়ে দাও, ধ্বংস করো।

আমাদের এখানেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা যারা সাংবাদিকতা করি তা প্রতিনিয়তই টের পাই। সর্বত্রই তো এই নীতি–‘কিল দা মেসেঞ্জার’।

One thought on “সিনেমার গল্প: কিল দা মেসেঞ্জার”

  1. আপনার লেখা পড়ে সিনেমাটা দেখার আগ্রহ জেগেছে।আশা করছি আরও লিখবেন। পরবর্তি কাহিনির অপেক্ষায় রইলাম।

    Like

Leave a comment