আরও নতুন ব্যাংক কেন?

bf40e35f4b79fa46f514cbebf916ede8-3

নতুন দুটি ব্যাংক দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছ। এ সংখ্যা বাড়তে পারে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই এই নতুন ব্যাংক দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক পরিচালনা মূলত একটি অর্থনৈতিক বিষয় হলেও আমাদের দেশে ব্যাংক নিয়ে প্রায় সব ধরনের সিদ্ধান্ত হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়।

২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার নতুন ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেই সে সময় বলেছিলেন, ব্যাংক দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। ফলে ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হিসেবে অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাকে মোটেই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বরং রাজনৈতিক অবস্থান দেখে দেওয়া হয়। মূলত দলের নেতা-কর্মীরাই পান নতুন ব্যাংক। এর ফল যে ভালো হয়নি, তা আমরা সবাই জানি।

গত নভেম্বরে নতুন ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে জরুরি ভিত্তিতে একটি বৈঠক করতে হয়েছে। কারণ, তাদের খেলাপি ঋণ বেড়েছে, বাড়ছে পরিচালন ব্যয়। এমনকি নিয়ম না মানার অনেক উদাহরণও ছিল। বেড়েছে দুর্নীতি। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের অবস্থা ছিল বেশি খারাপ। ফলে বেশ কিছু কঠোর নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয়নি।

এ কথা সবাই মানেন যে দেশে নতুন ব্যাংকের কোনো প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেও নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার বিপক্ষে ছিল। নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন আছে কি না, এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সমীক্ষা করেছিল ২০১১ সালে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, ‘আমাদের অর্থনীতির আকারের তুলনায় কার্যরত ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। সীমিত বাজারে অধিকসংখ্যক ব্যাংকের উপস্থিতিতে অসম প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। তীব্র প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলোর প্রধান আয় খাত একদিকে যেমন সংকুচিত হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি ব্যাংকগুলো অফ-ব্যালান্সশিট কার্যক্রমে অধিক আগ্রহী হয়ে পড়েছে, যা ব্যাংকিং খাতের সুষ্ঠু বিকাশের সহায়ক নয়।’ এই সমীক্ষার পরেও বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছায় নতজানু হয়ে নতুন ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছিল।

যদিও কাগজে-কলমে, কিন্তু নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৩১ ধারায় ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২-এ সরকার বিভিন্ন নির্দেশনার ভিত্তিতে নতুন নির্দেশনা দিতে পারবে বলে উল্লেখ ছিল। ২০০৩ সালে তা তুলে নেওয়া হলে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত হয়। কিন্তু আইনটি চর্চা করার সাহস বা ইচ্ছা কোনোটাই হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংকের এখনো নেই।

তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি নয়, আহ্বান জানাচ্ছি অর্থমন্ত্রীর প্রতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। আরও নতুন ব্যাংক নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার, তাতে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন আগেই ছিল না। তারপরও সীমান্ত ব্যাংকসহ ১০টি নতুন ব্যাংক দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে গুণগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং অসুস্থ প্রতিযোগিতা বেড়েছে। সুতরাং নতুন ব্যাংক নিয়ে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে উচিত হবে অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলো নিয়ে একটি ভালো সমীক্ষা করা। অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারছে কি না তা বিশ্লেষণ করে দেখা। ব্যাংকগুলো নতুন কিছু করতে পারল নাকি তা দেখা। আসলে নতুন ব্যাংক নতুন কোনো কিছুই ব্যাংকিং সেবায় যোগ করতে পারেনি। অন্য ব্যাংক যা এত দিন করে আসছে, সেটাই যদি করতে থাকে তাহলে নতুন ব্যাংক দেওয়া কেন?

একটা যুক্তি কেউ কেউ দিয়ে থাকেন। আর তা হলো এখনো দেশের অনেক মানুষ ব্যাংকিং সেবার বাইরে। তাদের ব্যাংকের আওতায় আনতে বা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ে তুলতে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) করা একটি জরিপের কথা বলা যেতে পারে। গত ডিসেম্বরে করা ওই জরিপে বলা হয়, দেশের ৯৫ শতাংশ ব্যাংকারই চান না দেশে নতুন করে আর কোনো ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হোক। নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে ছিলেন ব্যাংকের গ্রাহকেরাও। ৫৫ শতাংশ গ্রাহক নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে মত দেন। তাহলে ব্যাংকিং সেবার আওতা বাড়ানোর কী উপায়? এর উত্তরও ছিল জরিপ। ৯২ শতাংশ গ্রাহক ও ৭৫ শতাংশ ব্যাংকার বলেছিলেন বর্তমানে কার্যরত ব্যাংকগুলোই নতুন নতুন শাখা খুলতে পারে। দেশের এখনো অনেক জায়গা আছে যেখানে ব্যাংকের শাখা নেই। আবার এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে গায়ে গায়ে লাগানো ব্যাংকের শাখা। সুতরাং পল্লি অঞ্চলে শাখার সংখ্যা কীভাবে বাড়ানো যায় সেটা নিয়ে কাজ করলেই নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন থাকে না।

আমরা জানি এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সময়ে ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ আরও ১৩টি ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছিল। তখনো দলীয় বিবেচনায় ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। অন্যদিকে ২০০১-০৬ সময়ে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক চাপ থাকলেও সে সময়ের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্ত অবস্থানের কারণে তা হয়নি। এরশাদ আমলে (১৯৮২-৯০) প্রথম বেসরকারি খাতে ব্যাংক দেওয়া হয়। ওই সময়ে ৯টি ব্যাংক এবং এরপর বিএনপির প্রথম দফায় (১৯৯১-৯৬) দেওয়া হয়েছিল আরও ৮টি ব্যাংক। দেশে বর্তমানে ৫৭টি তফশিলি ব্যাংক রয়েছে।

এ নিয়ে কথা বলেছি বাংলাদেশ ব্যাংকেরই সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের সঙ্গে। তিনি বললেন, দেশের অর্থনীতির যে আকার, সে তুলনায় এমনিতেই ব্যাংক অনেক বেশি হয়ে গেছে। এতগুলো ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল না। ফলে নতুন ব্যাংক দিলে অর্থনীতিতে চাপ বাড়বে।

৫৭টি ব্যাংক নিয়ে যে ব্যাংক খাত, তা মোটেই ভালো চলছে না। একের পর এক কেলেঙ্কারির ঘটনা অতীতে ঘটেছে, এখনো ঘটছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো মৃতপ্রায়, করের টাকায় টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংকের অবস্থাও ভালো নয়। আবার এতগুলো ব্যাংক দেখভাল করার ক্ষমতা আছে কি না, সে প্রশ্নও রয়েছে। এ অবস্থায় নতুন ব্যাংক নয়, বরং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অন্য কোনো ভালো ব্যাংকের সঙ্গে কীভাবে একীভূত করা যাবে, সেই আলোচনা করাই প্রয়োজন। স্লোগান হওয়া উচিত আর নতুন কোনো ব্যাংক নয়, বরং পুরোনোগুলোকেই টিকিয়ে রাখি। এই কাজটি কিন্তু মোটেই সহজ নয়।

০৯ মার্চ ২০১৭, প্রথম আলো

Leave a comment