বইয়ের ঝাপি

আমি তখন ক্যাডেট কলেজে পড়ি, আর আমরা থাকতাম নাখাল পাড়ায়। সে সময়ে একটা সেল্ফ কেনা হল। সেল্ফের তিনটা তাক। উপরেরটায় স্থান পেলে কাপ-পিরিচ-প্লেট-গ্লাস ইত্যাদি। নীচের তাকে আমার ছোট ভাইয়ের নানা ধরণের খেলনা। আর মাঝের তাকটা আমি দখল করলাম, তখন আমার সংগ্রহে ১০/১৫টা বই। এর বেশির ভাগই পুরস্কার পাওয়া। একটা সময় সেই সেল্ফ পুরোটাই আমার দখলে এলো। কিন্তু তাতেও বই ধরে না। তারপর কিনলাম আরেকটা। একসময় এই সেল্ফও বইয়ে ভরে গেল। গত বছর অটবি থেকে কিনলাম আরেকটা। সেটিও এখন ভর্তি।
এর মধ্যে সবচেয়ে পুরানোটা বয়সের ভারে আক্রান্ত। ঈদের ছুটিতে বসেছিলাম পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানে। বিশেষ করে সামনে পেছনের সারির বইগুলোর দিকেই মনোযোগ দিতে হল, যেগুলো খানিকটা ছিড়ে গিয়েছিল অতি ব্যবহারের কারণে। কিংবা কিনেছিলামই পুরান বই, ফু্টপাত থেকে।

সেল্ফের সব বই নামিয়ে ঠিকঠাক করতে গিয়ে দেখি আমার কাছে বেশ চমকপ্রদ কিছু বই আড়ালে আবডালে রয়ে গেছে। আবার কিছু বই সামনেই ছিল, কিন্তু অনেকদিন আর হাতে নেওয়া হয়নি।

আবার এখনো আমি সময়-সুযোগ ও টাকা থাকলে বইয়ের দোকানে ঢু মারি। পুরানো বই খুঁজি। নতুন কি বেরোলো দেখি। এমনি করেও কেনা হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ বা মজার কিছু বই।

আবার আমাদের অফিসে একই মোটামুটি ভাল লাইব্রেরি আছে। পত্রিকা জগতে এরচেয়ে ভাল লাইব্রেরী আছে বলে আমার জানা নেই। সেখানেও মাঝেমধ্যে বইয়ের মধ্যে ডুকে থাকি। পেয়েও যাই উল্লেখযোগ্য কিছু বই।

ভাবছিলাম কদিন ধরেই এসব বই নিয়ে কিছু লিখবো। তারই প্রথম চেষ্টা এই পোস্ট।

১. বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি: সাবেক প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের লেখা। মোসতাক আহমেদ পদচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। আর সে সময়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। কি পরিন্থিতিতে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন আর কি পরিস্থিতিতে জিয়ার হাতে ক্ষমতা দিতে হয়েছিল তারই বর্ণনা। মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‌’১৯৭৭ সালের শেস ও ১৯৭৮ সালের শুরুর সময়ে এই সংক্ষিপ্ত লেখা তৈরি হয়। আমার মৃত্যুর পর তা প্রকাশের ইচ্ছা ছিল।’
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এর মধ্যে এমন কিছু কথা আছে যা তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ হোক চাননি। তারপরেও এটি প্রকাশ পেয়েছিল তিনি বেঁচে থাকতেই।
এই বই নিয়ে খুব বেশি আলোচনা আমি শুনিনি। তবে ছোট্ট এই বইটির সারমর্ম আমার কাছে দেশের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।
মাওয়া ব্রাদার্স এর প্রকাশক। বইটি নিয়ে আলাদা করে কিছু লেখার ইচ্ছা আছে।

২. বঙ্গভবনে মোশতাকের ৮১ দিন: আবু আল সাইদ একজন সাংবাদিক। সে সময়ে সংবাদে কাজ করতেন। সাংবাদিকতার সূত্রে পাওয়া এবং দেখা বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ। বইটিতে মজার মজার বেশ কিছু তথ্য আছে্। সেই সময়কার পরিবেশ ও পরিস্থিতির একটা চিত্র পাওয়া যায় বইটিতে।

৩. কনফিডেনশিয়াল ডায়েরী:বিক্রমাদিত্য নামের একজনের লেখা। ছদ্ম নামে লেখা সম্ভবত। এই নামে তিনি আরও বেশ কিছু স্পাই থ্রিলার লিখেছেন। ভদ্রলোক ৭৫ ও ৭৬ সালে বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবারেস কর্মরত ছিলেন। জিয়া তাকে বহিস্কার করেছিল। সেই সময়কার বাংলাদেশ নিয়ে লেখা। বেশ চমকপ্রদ তথ্য সম্বলিত একটা বই।

৪. এরশাদের পতন ও সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী শাসন: কাছ থেকে দেখা– মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ (অব.) এর লেখা। তিনি এরশাদের সামরিক সচিব ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এরশাদকে কাছ থেকে দেখেছেন।পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েও এরশাদ ক্ষমতা ধরে রাখার যেসব চেষ্টা করেছিলেন এবং এরশাদের দুর্নীতির অনেক মজার মজার তথ্য আছে বইটিতে।

৫. আমলার দিনলিপি
: কাজী ফজলুর রহমান সাবেক আমলা। নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। ১ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালের শেষদিন পর্যন্ত লেখা। সে সময়ে সেই অস্থির সময়ের প্রশানের একটি চিত্র পাওয়া যায় বইটিতে। মাওলা ব্রাদার্সের বই।

৬. শিকল পরা দিনগুলো
: লেখক এ বি এম খালেক মজুমদার। আল বদর সদস্য। শহীদুল্লাহ কায়সার অপহরণ ও হত্যার অন্যতম প্রধান আসামী। সাধারণ ক্ষমা পেয়ে মুক্তি পাওয়ার পর সেই বিচারকালীন সময় নিয়ে লেখা বই। ‘ আমাদের ভাগ্যে যখন একাত্তরেরর বিপর্যয় নিমে এলো তখন একা থাকি ঢাকায়’—–এরকম অনেক কথা আছে বইটিতে। ওদের মনোভাব বুঝতে পারা যায় বইটি পড়ে।

৭. একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের বিচার:
সাংবাদিক মোস্তাক হোসেনের লেখা। মূলত দালাল আইনে যখন বিচার ও গ্রেপ্তার পর্ব চলছিল সে সময়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের একটা সংকলন। রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখযোগ্য একটা বই।

৮. একাত্তরের ঘাতক জামাতে ইসলামীর অতীত ও বর্তমান: একাত্তরের ঘাতক দালারেরা কে কোথায় ছাড়াও ১৯৮৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র এই বইটি বের করেছিল। জামাতে ইসলামিকে বোঝার জন্য খুব ভাল একটা বই।

৯. ঐতিহাসিকের নোটবুক
: বাংলাপিডিয়া খ্যাত সিরাজুল ইসলামের লেখা একটি বই।ইতিহাসের ছোট ছোট অনেক মটনা আছে বইটিতে। কথাপ্রকাশ বের করেছে।

১০. একটি পেরেকের কাহিনী: সাগরময় ঘোষের লেখা, দেশ পত্রিকার সম্পাদক। ডা. বিধানচন্দ্র রায়কে নিয়ে লেখা একটা গল্পের মতো লেখা বই। বৈদ্যনাথ নামের একচন অতি সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিধানচন্দ্র রায়ের সম্পর্ক নিয়ে বই। অসাধারণ।

One thought on “বইয়ের ঝাপি”

  1. স্যার, আপনার লেখাগুলো পড়লাম। বই পড়তে আমিও ভালোবাসি।অনেকগুলো অজানা বইয়ের নাম টুকে নিলাম। আকর্ষণীয় করে লিখেছেন বই আর মুভিগুলোর নাম। দেখবো আর সবগুলো বই সম্ভবত হার্ডকপি সহজলভ্য নয়, এমনকি সফটকপিও নেই। তখন আপনার দারস্থ হব। আশা করি নিরাশ করবেন না।

    Like

Leave a comment